সীতাকুণ্ডের নদী মোহনায় অবস্থিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত। তবে কেবল গুলিয়াখালীই সমুদ্র সৈকত নয় এখানে আছে ১২৩০ ফুট উচ্চতার চন্দ্রনাথ পাহাড়, বোটানিক্যাল গার্ডেন ইকোপার্ক, আকিলপুর সমুদ্র সৈকতসহ বেশ কয়েকটি ঝর্ণা। প্রতিদিন শত শত পর্যটকের পদচারণা এই শহরতলীতে। এরপরও সুনামের বদলে দুর্নাম কুড়াচ্ছে সীতাকুণ্ড পৌর কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে পৌরসভার সাবেক মেয়র বদিউল আলম প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মহাসড়কের পাশে ময়লা ফেলার নির্দেশ দেন। তার পরিবেশ বিধ্বংসী এক উদ্যোগ ভোগাচ্ছে পৌরবাসীকে বছরের পর বছর। নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশন না করেই মহাসড়কের পাশে ময়লা ফেলা শুরু হয়। সেই থেকে দুর্গন্ধ আর ময়লা-আবর্জনার পৌর শহর সীতাকুণ্ড। এসব কারণে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের বদলে সীতাকুণ্ডকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য আসছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে।
দেড় যোগ ধরে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশের একটি স্থান যেন মরা হাঁস-মুরগি, গৃহস্থালি বর্জ্যসহ ডজনখানেক ক্লিনিক-হাসপাতালের ইনফেকটেড মেডিকেল বর্জ্য, হাটবাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মুরগি-খামারের বিষ্ঠা এমনকি মৃত পশুর দেহ আর ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড় হয়ে উঠেছে।
ঢাকা থেকে আসার পথে উপজেলার বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের ছোটদারোগারহাট পেরুলেই শুরু সীতাকুণ্ড পৌরসভার সীমানা। প্রথমে নুনাছড়া, এরপর শেখপাড়া এলাকা। সেখানে মহাসড়কের পাশে অন্তত ৪০০ গজ জায়গা জুড়ে চোখে পড়বে ময়লার ভাগাড়। মহাসড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা ময়লার দুর্গন্ধের এমন অবস্থা যেন নাক চেপে ধরেও সহ্য করার জোঁ নেই।
অথচ সীতাকুণ্ড পৌরসভা পার করেছে প্রতিষ্ঠার ২৬টি বছর। বছরের পর বছর সংস্থাটির কাণ্ডারিরা শুনিয়েছেন আধুনিক বর্জ্য শোধনাগারের গাল-গপ্প। আধুনিক বর্জ্য শোধনাগার তো দূরের কথা এখনও পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনার সুষ্ঠু কোন ব্যবস্থাপনাই করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে দিনের পর দিন পৌরসভার এই প্রবেশ দ্বারই হয়েছে ময়লার ভাগাড়। মহাসড়কের পশ্চিম পাশের খালি জায়গায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে (ডাস্টবিন) পরিণত হয়েছে। পথচারীরা দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চেপে চলাচল করছে কেউ কেউ হাত দিয়ে নাকমুখ চেপে ধরে চলাচল করছেন।
আবর্জনার দুর্গন্ধ বাতাসে মিশে আশপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এই এলাকা দিয়ে চলাচল করার সময় ময়লার দুর্গন্ধে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নারী ও শিশুরা। ভুগছেন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য সাধারণ মানুষ। ময়লার স্তূপে পথচারীদের চলাচলের ফুটপাথ বন্ধ হয়ে যায়। পৌরবাজার এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডের ময়লা আবর্জনা ফেলতে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা। পৌরসভা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ধীরে ধীরে তা ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়। এতে পথ চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হওয়ায় মহাসড়কের এ স্থানে প্রায়শ ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
বছরের পর বছর সড়কের ধারে ময়লা ফেলা হচ্ছে, কৃষি জমি, শস্য ও পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, সেইসাথে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। রোগজীবাণু বাসা বেঁধেছে, এখানেই ডেঙ্গুর চাষ হচ্ছে। তেমনি চলাচলে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন পথচারীরা।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারগামী লাখো মানুষ ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষ ও স্কুল কলেজের হাজারো শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এই পথে যাতায়াত করে। অথচ সড়কের পাশেই দিনের পর দিন এভাবে আবর্জনা পড়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। আবর্জনার ডিপোর উভয় পাশে অন্তত এক কিলোমিটার এলাকায় সারাক্ষণ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিগত দেড় যুগ ধরে পৌরসভার যাবতীয় বর্জ্য এখানে এনে ফেলা হচ্ছে। অথচ প্রতিবার নির্বাচনের আগে মেয়র প্রার্থীরা বিজয়ী হলে এখান থেকে বর্জ্য’র স্তূপ সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে আশ্বাস শুধুমাত্র আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো ময়লার ডিপোকে আকারে আরও বড় করা হয়েছে। প্রথমদিকে সীমিত পরিসরে আবর্জনা ফেলা হলেও বর্তমানে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। পৌরসভার ময়লা ফেলার সুযোগ নিয়ে আশেপাশের কয়েকটি মুরগির হ্যাচারী ও বিভিন্ন কারখানার উচ্ছিষ্ট বর্জ্যও এখানে ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সৈয়দপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বাকখালী এলাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, হঠাৎ এই স্থানটি অতিক্রম করার সময় দুর্গন্ধ নাকে ধাক্কা দেয়। তখন মন খারাপ হয়ে যায়। পরে নাক চেপে ধরি। এই অবস্থায় এস্থান দিয়ে স্বাভাবিক যাতায়াত করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
আরেক বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন বলেন, এই জায়গা দিয়ে আমাদের বহনকারী গাড়ী যাওয়ার সময় হঠাৎ নাকের মধ্যে খুব খারাপ একটা দুর্গন্ধ অনুভূত হল। তাৎক্ষণিক আমার বুমি বুমি ভাব শুরু হয়। আসলে এই পথ দিয়ে চলাচল করা কারো জন্য উচিত নয়।
সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলতাপ হোসেন সতর্ক করেছেন, এই বর্জ্য থেকে ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, স্কিন ডিজিজসহ মারাত্মক সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। জমে থাকা আবর্জনায় জন্ম নিচ্ছে মশা-মাছির ঝাঁক, ইঁদুরের উপদ্রব। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষেরা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে।
সীতাকুণ্ডবাসী এখন এই মাথাব্যাথা থেকে নিস্তার চাই। তাই সংশ্লিষ্টদের কাছে স্থানীয় বাসিন্দা, পথচারী এবং পরিবেশ প্রেমীদের দাবী দ্রুত ময়লার ভাগাড়টি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌর প্রশাসক মোঃ ফখরুল ইসলাম জানান, পৌরসভার নিজস্ব জায়গা নেই, খাস জমিও মেলে না। আবার জায়গা কিনতে গেলে কোষাগারে চাপ পড়বে। এখানে বর্জ্যগুলো না ফেলে অন্যত্র ফেলার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটার জন্য বিকল্প জায়গা দেখা হচ্ছে।