চট্টগ্রাম 3:45 am, Saturday, 12 July 2025

সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাব এখন ভয়ংকর টর্চার সেল!

বিগত ৩ মে সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাব পুনরায় দখল করে নেয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পদধারী একাধিক নেতা ও তাদের অনুসারীরা। তারপর থেকেই সাংবাদিকদের এই আশ্রয়স্থল যেন রূপ নেয় এক ভয়ংকর টর্চার সেলে। প্রতিনিয়ত এখানে জিম্মি করা হচ্ছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ—রিকশাচালক, দিনমজুর কিংবা নির্মাণ শ্রমিকদের। তাদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।

গত সোমবার (৭ জুলাই) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাণ শ্রমিককে প্রেস ক্লাবে আটক রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে স্থানীয় ছাত্র-জনতার একটি দল ক্লাব অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর প্রেস ক্লাবের ভেতরে চলা দীর্ঘদিনের গোপন টর্চার সেলের লোমহর্ষক চিত্র প্রকাশ্যে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীরা জানান, প্রেস ক্লাবের ভেতরে নিয়মিত চলতো মদ, গাঁজা ও ইয়াবা সেবন। একইসঙ্গে নিরীহ মানুষদের উপর চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এসব অপকর্ম থেকে আদায়কৃত মুক্তিপণের অর্থ যেত ক্লাব দখলে রাখা আওয়ামী দোসরদের পকেটে।

সীতাকুণ্ড মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুজিবুর রহমান জানান, “প্রেস ক্লাবে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। তবে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়, ফলে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।”

ওই রাতের সাড়ে ১১টায় অভিযান চালান এএসআই রাশেদুল আলম। তিনি বলেন, “মার্কেটের দারোয়ানকে ডেকে গেট খুলে ক্লাবে প্রবেশ করি। তখন দেখি সবাই পালিয়ে গেছে। ভেতরে মাদক ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম দেখতে পাই। এসবের ছবি ও ভিডিও আমি ফোরকান আবুকে হস্তান্তর করি।”

জিম্মি অবস্থায় উদ্ধার পাওয়া সেই নির্মাণ শ্রমিক জানান, “আমাকে প্রথমে প্রেস ক্লাবের উপরের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নিচতলায় এনে মুক্তিপণ দাবি করে মারধর শুরু করা হয়। এক পর্যায়ে আমাকে ফোন দিয়ে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়। তখন আমি কৌশলে ‘প্রেস’ শব্দটি উচ্চারণ করি, যাতে আমার স্বজনরা বুঝতে পারেন আমি কোথায় আছি।”

তিনি বলেন, “রাতে পুলিশ প্রেস ক্লাবে প্রবেশ করলে দুইজন জিম্মিকারী সেখানে থেকে যায়, বাকিরা পালিয়ে যায়। তারা নিজেকে দারোয়ান পরিচয় দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে। পুলিশ চলে যাওয়ার পরও আমি নিচতলার একটি কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। পরে ১৫-২০ জনের একদল ছাত্র-জনতা এসে আমাকে উদ্ধার করে।”

আলী মার্কেটের এক চা দোকানদার খোকন জানান, “সেদিন পুলিশ আসলে আমি মার্কেটের গেটের তালা খুলে দিই, ততক্ষণে সবাই পালিয়ে যায়। পরে প্রেস ক্লাবে মাদকের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দোকানদারও নিশ্চিত করেছেন—প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে ইয়াবা সেবন এবং মারধরের ঘটনা প্রায়ই ঘটত।

তাদের ভাষায়, “এখানে আগে অনেককেই এনে পিটানো হয়েছে, কিন্তু কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না।”

এই ঘটনা প্রকাশ্যে এলে উপজেলাজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব প্রতিক্রিয়া জানান সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মহল। তারা এক কণ্ঠে দাবি তুলেছেন—প্রেস ক্লাব থেকে দখলদার ও সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে উচ্ছেদ করে সেটিকে প্রকৃত সাংবাদিকদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তারা বলছেন, “প্রেস ক্লাব যেন আর কারও টর্চার সেল না হয়ে, সাংবাদিকদের মর্যাদাপূর্ণ ঠিকানা হয়—এখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ দরকার।”

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

মিরসরাই ট্র্যাজেডির নিহতদের শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ

সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাব এখন ভয়ংকর টর্চার সেল!

Update Time : 06:52:00 pm, Thursday, 10 July 2025

বিগত ৩ মে সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাব পুনরায় দখল করে নেয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পদধারী একাধিক নেতা ও তাদের অনুসারীরা। তারপর থেকেই সাংবাদিকদের এই আশ্রয়স্থল যেন রূপ নেয় এক ভয়ংকর টর্চার সেলে। প্রতিনিয়ত এখানে জিম্মি করা হচ্ছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ—রিকশাচালক, দিনমজুর কিংবা নির্মাণ শ্রমিকদের। তাদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।

গত সোমবার (৭ জুলাই) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাণ শ্রমিককে প্রেস ক্লাবে আটক রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে স্থানীয় ছাত্র-জনতার একটি দল ক্লাব অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর প্রেস ক্লাবের ভেতরে চলা দীর্ঘদিনের গোপন টর্চার সেলের লোমহর্ষক চিত্র প্রকাশ্যে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীরা জানান, প্রেস ক্লাবের ভেতরে নিয়মিত চলতো মদ, গাঁজা ও ইয়াবা সেবন। একইসঙ্গে নিরীহ মানুষদের উপর চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এসব অপকর্ম থেকে আদায়কৃত মুক্তিপণের অর্থ যেত ক্লাব দখলে রাখা আওয়ামী দোসরদের পকেটে।

সীতাকুণ্ড মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুজিবুর রহমান জানান, “প্রেস ক্লাবে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। তবে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়, ফলে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।”

ওই রাতের সাড়ে ১১টায় অভিযান চালান এএসআই রাশেদুল আলম। তিনি বলেন, “মার্কেটের দারোয়ানকে ডেকে গেট খুলে ক্লাবে প্রবেশ করি। তখন দেখি সবাই পালিয়ে গেছে। ভেতরে মাদক ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম দেখতে পাই। এসবের ছবি ও ভিডিও আমি ফোরকান আবুকে হস্তান্তর করি।”

জিম্মি অবস্থায় উদ্ধার পাওয়া সেই নির্মাণ শ্রমিক জানান, “আমাকে প্রথমে প্রেস ক্লাবের উপরের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নিচতলায় এনে মুক্তিপণ দাবি করে মারধর শুরু করা হয়। এক পর্যায়ে আমাকে ফোন দিয়ে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়। তখন আমি কৌশলে ‘প্রেস’ শব্দটি উচ্চারণ করি, যাতে আমার স্বজনরা বুঝতে পারেন আমি কোথায় আছি।”

তিনি বলেন, “রাতে পুলিশ প্রেস ক্লাবে প্রবেশ করলে দুইজন জিম্মিকারী সেখানে থেকে যায়, বাকিরা পালিয়ে যায়। তারা নিজেকে দারোয়ান পরিচয় দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে। পুলিশ চলে যাওয়ার পরও আমি নিচতলার একটি কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। পরে ১৫-২০ জনের একদল ছাত্র-জনতা এসে আমাকে উদ্ধার করে।”

আলী মার্কেটের এক চা দোকানদার খোকন জানান, “সেদিন পুলিশ আসলে আমি মার্কেটের গেটের তালা খুলে দিই, ততক্ষণে সবাই পালিয়ে যায়। পরে প্রেস ক্লাবে মাদকের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দোকানদারও নিশ্চিত করেছেন—প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে ইয়াবা সেবন এবং মারধরের ঘটনা প্রায়ই ঘটত।

তাদের ভাষায়, “এখানে আগে অনেককেই এনে পিটানো হয়েছে, কিন্তু কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না।”

এই ঘটনা প্রকাশ্যে এলে উপজেলাজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব প্রতিক্রিয়া জানান সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মহল। তারা এক কণ্ঠে দাবি তুলেছেন—প্রেস ক্লাব থেকে দখলদার ও সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে উচ্ছেদ করে সেটিকে প্রকৃত সাংবাদিকদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তারা বলছেন, “প্রেস ক্লাব যেন আর কারও টর্চার সেল না হয়ে, সাংবাদিকদের মর্যাদাপূর্ণ ঠিকানা হয়—এখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ দরকার।”