আকাশের রং পরিবর্তন হচ্ছে। ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চারপাশ। একবারে ধবধবে নীল আকাশ। তার মাঝে সাদা মেঘের দল ভেসে যাচ্ছে এদিক থেকে এদিকে। বাতাসে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া। এবার কাশফুল ফুটবে। যদিও এসময় সূর্য যখন মধ্যাকাশে টাল খেয়ে যায়। তখন প্রখর রোদের তেজ চামড়া পোড়ায়। যারা মাঠে কাজ করে তাদের পিঠে লবন জমে। হ্যাঁ এটি ভাদ্র মাস। আর ঠিক একমাস পরেই আশ্বিন আসবে। এ কারণেই হয়তো প্রকৃতির রোদ, জল মাপামাপা। মানুষের জীবনে ঋতুর প্রভাব বিদ্যমান। প্রতিটি ঋতু আলাদা আলাদাভাবে মানুষের শরীর মনকে স্পর্শ করে যায়। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সাথেসাথে প্রকৃতি বদলায়। পৃথিবী নতুনরূপে সাজে। কারণ জন্মাষ্টমীর দিনেই যোগমায়ার জন্ম হয়। তার মায়াতেই সেদিন যমুনা উত্থাল হয়। প্রকৃতি রুদ্র রূপ নেয়। চারদিক অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।
বাসুদেব কৃষ্ণকে নিয়ে কংসের কারাগার থেকে বের হন। কারগারের দরজা আপনাআপনি খুলে যায়। প্রহরীরা ঘুমিয়ে থাকে। প্রতিটি ঘটনার জন্য পরিবেশ, পরিস্থিতির তৈরি করতে হয়। যদি সেদিন যোগমায়ার জন্ম না হত তাহলে বিষয়টি হয়তো অন্যরকমও হতে পারতো।
সবকিছু একি ব্রহ্মের সৃষ্টি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, যোগমায়া সবই ব্রহ্মের কীর্তি। যোগমায়া হচ্ছে পরমা প্রকৃতি। তিনি এ প্রকৃতির অধিশ্বর। তিনিই আবার অন্যরূপে অসুরদলনে দশভূজা দূর্গা, মহামায়া কালী, চণ্ডী। পৃথিবীর ক্রান্তিলগ্নে অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, ধর্মের গ্লানি হয় তখনি যুগে যুগে ধর্ম পুনঃস্থাপনের জন্য মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে।
বর্তমান সময়টা হচ্ছে সবচেয়ে সর্পিল সময়। বলতে পারি একটা ভয়ংকর খারাপ সময় আমরা অতিক্রম করছি। প্রতিনিয়ত হিংসা, বিদ্বেষ, খুন, জখম, ধর্ষণের মত খারাপ কাজে লিপ্ত মানুষেরা। এ কারণেই মানুষে-মানুষে হানাহানি, দেশে-দেশে যুদ্ধ লেগেই আছে। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না। দুঃসময়ে কেউ কাউকে সাহায্য করার জন্য এগিয়েও আসে না আজকাল। কেনো এমন হচ্ছে? এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের ঈশ্বরের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। আমরা সৎ কার্যে লিপ্ত নই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাপাচার আমাদের গ্রাস করছে ক্রমশ। এ কারণেই আমাদের এত দুর্গতি, দুঃখ, দহন। অনবরত জ্বলছে মানুষ ভেতরে ভেতরে। কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে পারছে না।
পূজা আসলে এক ধরণের শিল্প। আহ্বান, নিবেদন, বিসর্জনের ভেতর পূজা সীমাবদ্ধ মনে হলেও পূজার ব্যাপ্তি অনেক বড়। আমাদের পূজার যে কাঠামো তা হচ্ছে অফুরন্ত শক্তির কাঠামো। বলতে পারি একটি রাষ্ট্রের কাঠামো। এখানে এসবকে না জেনে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। শক্তি পূজার প্রতিটি পর্বেই লুকিয়ে আছে জীবনের অনন্ত বীজ, সার, সত্য। এ কারণেই মাতৃপক্ষে দেবী আরাধনায় অধিবাস থেকে শুরু বিসর্জন পর্যন্ত যেখানে পূজো হচ্ছে সেখানে পণ্ডিতবর্গ থেকে শুরু করে সবাইকে শুদ্ধভাবে দেবীর আরাধনায় ব্রতী হতে হয়। এ দেবী যেমন দশ হাতে মানুষের কল্যাণ করে আবার পাপীদের শাস্তি বিধান করেন; যেমন মহিষাসুরের করেছিলেন। এ কারণেই ধর্মগ্রন্থে বারবার বলা হয়েছে মানুষকে সত্যের পথে আসার জন্য, সুন্দরের পথে আসার জন্য, ধ্যানের পথে আসার জন্য।
এ সংসার হচ্ছে মায়া। পিতা, পুত্র, আত্মীয়, পরিজন সবই মায়ার খেলা। এর পরে আছে মৃত্যু। মৃত্যু হচ্ছে আমাদের কানাগলির শেষ মাথা। এখান থেকে ফেরার আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। মৃত্যু অমোঘ। সে মৃত্যু কেমন আমরা কেউ জানি না। হয়তো সে একটা পিঙ্গল বর্ণের মেয়ে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। করুণ শঙ্খের মত মুখ তার। চোখ জলে ভরা। তিনি সবাইকে ফিরিয়ে দিতে চান কিন্তু ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। সবাইকে তাই তিনি হাসিমুখে বলেন ‘চলে এসো’। আমরা না বুঝেই এ মায়ায় জড়িয়ে পরি। তখনি আমাদের রিপুগুলো জেগে ওঠে। আমরা অনিত্য একটা মায়ার সংসারে আবদ্ধ হয়ে যায়। ভুলে যাই আমাদের মহাজাগতিক ধ্যানকর্ম। এ কারণেই সাংসারিক পাপ; বিশেষ করে স্বার্থপরতা, বর্বরতা, পশুত্ব ধীরে ধীরে আমাদের গ্রাস করে।
এভাবে চললে তো হবে না। আমাদের সংহতি ফিরিয়ে আনতে হবে। পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের হিংসা দূর করতে হবে। পূজা হচ্ছে সমর্পণ। নিজের কলুষ-কালিমা বিসর্জন দিয়েই মানুষ পূজার জন্য উপযুক্ত হয়। আমরা যদি সেরকম সাত্ত্বিকভাবে মায়ের পূজা করতে পারি, যদি আমরা দশজনও বালক নারায়ণ তৈরি করতে পারি তবে যোগমায়ার আলোয় উদ্ভাসিত হবে আমাদের আগামীর পৃথিবী। যা এক আদেশে চলবে। তখনি সুন্দর হবে আমাদের দিনরাত্রি। মা এ শুভক্ষণে তোমার খড়গ কৃপানে খণ্ডিত কর আমাদের মনের যত অন্ধকার। জয় মা দূর্গেশ নন্দিনী, দুর্গতিনাশিনী।