জাল সনদের ব্যবসা ও বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে মুখ খোলায় সাউদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাময়িক অব্যাহতি (সাসপেনশন) দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ট্রেজারার ও বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য সচিব সরওয়ার জাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই অনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সনদ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। আর এসবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করায় এবং মামলার পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তড়িঘড়ি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে লঙ্গন করে ভিসিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধক্ষ্যকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
গত ২০ এপ্রিল ট্রাস্টি বোর্ডের সভা শেষে সদস্য সচিব (বিওটি) সরওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মো. মোজাম্মেল হকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, সাউদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব থেকে আপনাকে সাময়িক অব্যাহতি (সাসপেনশন) দেওয়া হলো। এই সাময়িক অব্যাহতির আদেশ সাউদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী আপনার বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড জন্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মাত্রা প্রকৃতি ও মাত্রা বিবেচনা করা হয়। আপনি সাউদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য অবৈধ কার্যকলাপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আর্থিক অনিয়ম অসাদাচারণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, ন্যায়পরায়ণতা, বৈধতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমরা এই সিদ্ধাতে উপনিত হতে বাধ্য হয়েছি। এই সিদ্ধান্ত ২১ এপ্রিল ২০২৪ থেকে কার্যকর হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, অব্যাহতিকালীন সময়ে আপনাকে আপনার ভূমিকার সাথে সম্পর্কিত সকল প্রকার দাপ্তরিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হলো। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে সাময়িকভাবে নিষেধ করা হলো।
ওই চিঠিতে ওই চিঠিতে আর উল্লেখ করা হয়, আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা হবে এবং আপনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করা হবে।
অব্যাহতি নিয়ে আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এবং আরও স্পষ্টীকরণ কিছু জানতে চাইলে বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান অথবা সেক্রেটারির সাথে যোগাযোগ করতে দ্বিধা করবেন না।
২০২১ সালের ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ চার বছরের জন্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই বছরের ১ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে হিসাবে উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ।
তবে সাউদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ট্রাস্ট বোর্ডের দেওয়া এই অব্যাহতিতে মানা হয়নি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০। আইন অনুযায়ী, দেশের সকর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য (চ্যান্সেলর) রাষ্ট্রপতি। ওই আইনে বলা হয়েছে, চ্যান্সেলর কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত কোন ব্যক্তিকে চার বৎসর মেয়াদের জন্য উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত করবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, চ্যান্সেলর সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কারণে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সুপরিশক্রমে ভাইস চ্যান্সেলরকে অপসারণ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে অপসারণের সিদ্ধান্তের আগে সংশ্লিষ্ট ভাইস চ্যান্সেলরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
অব্যাহতি পাওয়া ভিসি মো. মোজাম্মেল হক অভিযোগ করে বলেন, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেওয়া হয়নি। ২০ এপ্রিল ট্রাস্টির এক সভায় হঠাৎ করে ওনাকে বাইরে যেতে বলা হয়। এর কিছুক্ষণ পরে তাকে অব্যাহতির চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, এছাড়াও তাকে অবৈধভাবে গুন্ডার মতো হুমকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কেবল জাল সনদও আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় এটি করা হয়েছে। আর কেলেঙ্কারি ফাঁস করলে সরওয়ার জাহান ও যারা জাল সনদ কিনেছেন তারাসহ অনেকেই ফেঁসে যেতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা বিরাজমান। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা। একজন মাত্র ব্যক্তি সরওয়ার জাহান ২০০৩ সাল থেকে ট্রেজারার ছিলেন। বোর্ড সদস্য সচিব ও সাবেক ট্রেজারার সরওয়ার জাহান জাল সনদ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ২০২১ সালের মার্চে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো জাল সনদ দেওয়া হয়েছে সেটি অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করেন জানিয়ে মো. মোজাম্মেল হক বলেন, তিনি ৪০০টি স্নাতক সনদ যাচাই করে দেখতে পান ১০৫টি ভুয়া বা জাল।
সরওয়ার জাহান ট্রেজারার থাকাকালীন ২০১০ সালে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে বহু টাকা সরিয়ে নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক হিসেবে দেখা যায়, তিনি বিগত দশ বছরে ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তুলেছেন। যা ইন্টারেস্টসহ ৩ কোটির উপরে দাঁড়ায়। তাদের কাছে (বিওটি) জানতে চাইলে তারা প্রথমে জানাতে চাননি। তখন তারা বলে যে এটা বললে তাদের চাকরি থাকবে না। একসময় তৎকালীন ট্রেজারার সরওয়ার জাহান বিষয়টি স্বীকার করলেন যে এই টাকাগুলো একটি একাউন্টে জমা আছে এবং সেখানে আর টাকা জমা রাখা হয় না। আমি প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম এই টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিতে। তখনি তিনি বললেন, আমি এটার মালিক আমি ফেরত দেব কেন? আমার প্রতিষ্ঠান আমার টাকা আমি নিয়েছি আপনার সমস্যা কোথায়? অব্যাহতি পাওয়া ভিসি আরও বলেন, সরওয়ার জাহান একটি জায়গা থেকে ৭৫ লাখ টাকা লোন করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিশোধ বাবদ ২৮ লাখ টাকা তুলেও নিয়েছেন। কিন্তু কেন লোন করেছেন সেটি তিনি জানাননি তিনি। এমনকি বোর্ডও সমসময় এটিকে পাত্তা দিচ্ছিল না। মিটিংয়ে এজেন্ডা দিলেও কাগজপত্র নেই, ডকুমেন্টস নেই বলে বলে কালক্ষেপণ করতেন।
এভাবে ৮-১০ কোটি টাকার যখন দুর্নীতি হলো তখন আমি আমার দায়িত্ব মতে ইউজিসি, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি আমার নিয়োগকর্তা মাননীয় চ্যান্সেলরকে জানিয়েছি। এরপর সেখান থেকে একটি তদন্ত কমিটি হলে বোর্ড আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়। যদিও বোর্ডে কয়েকজন সৎ ব্যক্তি সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
মো. মোজাম্মেল হক আরও বলেন, আমাদের অনলাইনে সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনে সরওয়ার জাহান সবসময় কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছাড়াই ক্লিয়ার দিয়ে দিতেন। আমি অভিযোগ পেলাম, অনলাইনে কতগুলো ভুয়া সাইট তৈরি করে জাল সনদ দেওয়া হচ্ছে। এরপর আমি সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনটাকে অফলাইন করে দিলাম। তারপর বোর্ডে অভিযোগ দেওয়া হলো আমরা ভেরিফিকেশন করতে বিলম্ব করছি। আমরা বললাম কোনগুলো দেরি হচ্ছে দেখান। যেগুলো ফেইক বা জাল সেগুলো ভেরিফিকেশন করতে সময় লাগবে।
তিনি আরও বলেন, ২০২২-২৩ সালের ৫০০টি সনদ যাচাই করে আমি হিসাব করে দেখেছি ১০৫ টি জাল আছে। অর্থাৎ মোট সনদের ২৫ শতাংশ সনদ জাল। প্রতিষ্টালগ্ন থেকে আমাদের ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থী বের হয়েছেন। এর মধ্যে সেই হিসেবে ৬ হাজারটি সনদ জাল হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এগুলোর একেকটিতে ৫ লাখ টাকা করে লেনদেন হয়েছে যা হিসাব করলে ৩’শ কোটির উপরে দাঁড়ায়। তিনি আরও জানান, আমি ১০৫টি জাল সনদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই আমাকে সরানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ট্রেজারার ও বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টি সদস্য সচিব সরওয়ার জাহানকে একাধিকবার অনলাইন ও অফলাইনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির চলতি দায়িত্বে থাকা ও সাবেক ট্রেজারার প্রফেসর শরীফ আশরাফুজ্জামান মুঠোফোনে বক্তব্য প্রদানে রাজি হননি। সরাসরি অফিসে গিয়ে দেখা করার কথা বলেছেন তিনি।