চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী পৌরসভার মীরের হাট বাজারের পশ্চিমে রেললাইনের পাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুলেটে শহীদ অজ্ঞাত এক ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থলের (কবর) সাইনবোর্ড উধাও হয়ে গেছে।
বুধবার (০৪ জুন) বিকালের দিকে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ওই অজ্ঞাত ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থলে (কবর) লাগানো সাইনবোর্ডটি আর নেই, নেই কোনো চিহ্নও। তবে তার আশেপাশে বেঁধে রাখা হয়েছে কুরবানির হাটে বিক্রির জন্য আনা গরু।
জানা যায়, মিরেরহাটের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংগঠন ঝিনুক ক্লাবের পক্ষ থেকে ওই ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থলের (কবরের) পবিত্রতা রক্ষার জন্য একটি সাইনবোর্ড টাংগিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যাতে লিখা ছিলো ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর,পবিত্রতা রক্ষা করুন’ এবং বিশেষ বিশেষ দিবসে তারা ওই কবরে (সমাধি) ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাও জানাতেন বলে জানান স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কযেকজন বাসিন্দা ও দোকানের সওদাগর জানান, ঝিনুক ক্লাবের পক্ষ থেকে ওই ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থলের (কবরের) পবিত্রতা রক্ষার জন্য একটি সাইনবোর্ড টাংগিয়ে দেয়া হয়েছিলো এবং ১৬ ই ডিসেম্বর, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২৬ মার্চের মতো বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে ক্লাবটির পক্ষ থেকে ওই কবরে (সমাধি) ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাও জানাতেন।ঝিনুক ক্লাবের সহ স্থানীয় কয়েকজন হাটহাজারীতে শহীদ ২ জন ইপিআর সদস্যের কবর পাকা করার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেকবার আবেদন করার পরও কারো থেকেই কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে স্থানীয়রা বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার সহযোগীতা কামনাও করেন তারা। তবে দুঃখের বিষয় গত ৫ আগস্টের পর হঠাৎ কে বা কারা ওই সমাধিস্থল/কবর থেকে সাইনবোর্ডটি ফেলে দেয় এবং আশে পাশে বেশ কিছু দোকান নির্মাণ হয়। আর আজ দেখা গেলো সাইনবোর্ডটি না থাকায় কুরবানির হাটে গরু বিক্রি করতে আসা গ্রামের সহজ সরল মানুষজন সেই সমাধিস্থলের সামনে,আশে পাশে গরু বেঁধে রেখেছেন।
উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক ও হাটহাজারী প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম মনসুর আলীর দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাক হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অতর্কিতে বাংলাদেশী ইপিআর জোয়ানদের উপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে তখন অনেক বাংগালী ইপিআর সেনানিবাসের ব্যারাকে মারা গেলেও কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে বেঁচে যাওয়া ইপিআর সদস্যরা ভারতে গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। এমন একজন ইপিআর সদস্য পালিয়ে এসে ২৬ মার্চ প্রায় দুপুরে হাটহাজারী উপজেলার মুন্সী মসজিদে সাদা পোশাকে জোহরের নামাজ আদায় করতে প্রবেশ করেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, নামাজ শুরুর আগে হঠাৎ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার একটি সাঁজোয়া গাড়ী বহর মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং মুসল্লীদের তল্লাশি করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা ঐ সাদা পোশাকধারী ইপিআর সদস্যকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং শুধু তাকেই ধরে নিয়ে গিয়ে মীরের হাটের পশ্চিমে রেললাইনের পাশে গুলি করে হত্যা করে নজব আলী রোডের পাশেই ফেলে রাখে।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মুন্সীর মসজিদ থেকেই ওই ইপিআর সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। যে স্থানে ওই ইপিআর সদস্যকে গুলি করা হয়েছিলো সেদিন ঘটনার কিছুক্ষণ পর ভয়ে ভয়ে কিছু কিছু লোক সেখানে জড়ো হয়েছিলো। তখন পাক হানাদার বাহিনীর এক অফিসার উপস্থিত কয়েকজনকে ডেকে ওই ইপিআর সদস্যের লাশটি মাটিতে পুতে ফেলার নির্দেশ দেন। তখন স্থানীয় আনোয়ার ও আবু তাহের লেদু সহ আরও কয়েকজন মিলে রাস্তার পাশে আনোয়ারের ভোগদখলকৃত রেলওেয়ের জায়গায় তাকে দাফন করা হয়। যা এখনো বিদ্যমান। তারা সবাই জানায় যে, কবর দেয়ার জন্য যখন লাশের পাশে যায় তখন তার গায়ে ” ইপিআর ” লিখিত গেঞ্জি দেখে ইপিআর সদস্য নিশ্চিত হই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা পাক্ষিক উত্তর চট্টলার সম্পাদক ও প্রকাশক হাটহাজারী প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাংবাদিক এম দিদারুল আলম দুলাল দুুঃখ প্রকাশ করে বুধবার সন্ধ্যার দিকে এ প্রতিবেদককে বলেন, একজন শহীদের সমাধিস্থলের সাইনবোর্ড /স্সৃতি চিহ্ন ফেলে দিয়ে সেই স্থানের সামনে আশে পাশে দোকান তৈরী,গরু বাঁধা এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও ভিষণ লজ্জাজনক কাজ। আমি ওই শহীদের সমাধিস্থল/কবরের পবিত্রতা রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
অজ্ঞাত ওই ইপিআর সদস্যের সমাধিস্থল /কবর থেকে সাইনবোর্ড উধাও সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহেদ আরমান বুধবার রাতে এ প্রতিবেদককে ছুটিতে আছেন জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে বিষয়টি নিয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবিএম মশিউজ্জামান এর সাথে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানলাম, এটা খুবই দুঃখজনক। দ্রুত খবর নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।