চট্টগ্রাম 3:22 am, Thursday, 5 December 2024

রিফাতের সাথে ৬৯৩৫ দিন

এখন থেকে ঠিক ১৯বছর আগে রিফাতের সাথে আমার পরিচয় হয়। তখন পরনে ছিল একটা স্কুল ড্রস, একজোড়া দুই ফিতা ওয়ালা সেন্ডেল আর কাঁদে একটি ব্যাগ। তখন জীবনের মানে ছিল আমাদের কাছে নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল ড্রেস পড়ে স্কুলে আসা, টিফিনে হা-ডু-ডু কিংবা লুকোচুরি খেলা, কলম খেলা, সকালে জামাল স্যারের প্রাইভেট আর যতটা পারা যায় ফাঁকি দেওয়া। ধীরে ধীরে প্রাইমারি- হাই স্কুল-কলেজ- ভার্সিটি শেষে কর্মজীবনে সবে পা দিলাম দুজনে। ফসলের মত সময়ের সাথে পরিপক্ক হয়ে ওঠা বন্ধুত্ব হঠাৎ আসা কোনো ঝড়ের মতো গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় সে সম্পর্ক ৬৯৩৫ দিন একসাথে চলার পর ইতি টানলো। জীবন কখনো কখনো অনেক বড়ো পরীক্ষার অন্য এক নাম। তার এমন মৃত্যু আমাকে কাঁদায়, অনুভূতি শূন্য করে দেয়। রোগে ভুগে মৃত্যু হলেও মানসিকভাবে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু জীবনের সমস্ত বিপদ আপদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকা জ্বলজ্যান্ত মানুষটা হঠাৎ নাই হয়ে যাওয়া কিভাবে মানা যায়? অনন্তকাল ধরে কাঁদলে আমার ক্ষতির অনুভূতির গভীরতা বোঝা যাবে না। প্রচণ্ড শূন্যতা, প্রচণ্ড হাহাকার তার জন্য। এমন অনুভূতি আমি চাই না কখনোই। জীবনের সমস্ত বিপদ আপদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকা সবাইকে হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখা, বন্ধুদের সাথে সেলফি তোলা, আড্ডা দেওয়া ছিলেন এক জীবন্ত প্রাণ রিফাত তার সাথে স্কুল

জীবনের স্মৃতিঃ আমাদের শিক্ষা জীবনঃ স্কুল প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিলাম আকবর শিকদার পাড়া। প্রথমদিন ক্লাস ওয়ানে তার সাথে আমার পরিচয় হয় খেলাধুলার মাধ্যমে। ছোট বেলা থেকে সে ক্রীড়ামুখী ছিল। কখনও হা-ডু-ডু কখনো লুকোচুরি কিংবা দৌড়াদৌড়ি। প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে সেখান থেকে শুধু দুইজন ও আর আমি বৃহত্তর পরিবেশ উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথম তিনদিন ভয়ে স্কুলে যায়নি। পরেরদিন যাওয়ার পর সে আমাকে রিসিভ করে। একএক করে সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান দিল। সকালে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে স্কুলে যাওয়া, টিফিন টাইমে স্কুল পলায়ন করে ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা, কখনো লেট হলে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা, সমাবেশ ফাঁকা দিয়ে ঘুরতে যাওয়া দিনগুলো অস্থির ছিল। স্কুলে আমি, রিফাত, ইমরান আর জিশু ছিলাম এক ও অভিন্ন। কত দুষ্টামি কত কিছু সবকিছুর সাক্ষী স্কুলের দেয়াল আর বেঞ্চ গুলো। কলেজ জীবন ইন্টারে আমরা দুইজন আলাদা কলেজে ভর্তি হলেও প্রাইভেট ছিল একসাথে। তখন আমাদের সাথে এড হলো রহিম। দুইবছর পর আবারে অনার্সে ভর্তি হলাম একসাথে। তখন হয়ে গেলাম রহিমসহ আমরা তিনজন। শুরু হলো সব। এক এক করে চার বছর শেষ করলাম। শিক্ষা জীবনের সব চেয়ে মধুর স্মৃতি এখানে জড়িত। রিফাতের আদলে কত জনের সাথে বন্ধুত্ব হিসাব নাই। সে কলেজ শেষে নতুম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত। তাকে পেলে যে কতবার চলে আসছি হিসাব নাই। কলেজে প্যারা খাইলে একমাত্র তার জন্য খেতাম। সে আমার দূর্বলতাগুলো বলে দিত সবার সামনে। খুবই মজা হতো মুহুর্তগুলো। একসাথে কক্সবাজার সেন্টমার্টিন সমাপনী দিন পরীক্ষা কত জোস ছিল বলার মতো না। কলেজের বিভিন্ন টপিক সে আগেই শুরু করতো। এরপর আমরা সাড়া দিতাম। কলেজ নিয়ে সে সর্বশেষ স্টাটাস দিয়েছিল, “প্রিয়মুখ গুলোকে চাইলেও ভূলে থাকা সম্ভব না”। কিন্তু কদিন পর হয়তো তাকে সবাই ভূলে যাবে। এবস ভাবলে মনটা মুচড় দিয়ে ওঠে। টিউশন জীবন অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর আমরা তিনজনই টিউশন করাতাম। আমি পড়াতাম রহিমের কাজিনকে, রিফাত পড়াতো রহিমের ভাইপোকে আর রহিম পড়াতো তার এলাকার অন্য একজনকে। তিনটে টিউশন ছিল রহিমের বাড়ির পাশাপাশি। সপ্তাহের শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন আমরা পড়াতে যেতাম। এরপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রহিমের রুমে চলতো আমাদের আড্ডা। সে রহিমের ঘরে ডুকার আগে চিল্লাই বলতো আন্টি আমরা এসেছি কিছু খাব না, কিছু দিলে কিন্তু আমরা রাগ করবো। এটা বলা মানে আমাদের জন্য নাস্তা রেডি করা। রহিমকে সবসময় পাম্পিং করতো বিরানি রান্না করার জন্য। কারণ বিরানি ছিল আমাদের দুজনেরই প্রিয় খাবার। আমি জানি রহিমের আম্মুকে ভীষণভাবে ভুগাবে এই জিনিসটা। ভার্সিটি অনার্স শেষে আবার ভর্তি হলাম মহসিন কলেজে। জীবনে পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে রিফাত চলে যায় শহরে আমরা রয়ে গেলাম গ্রামে। সে চলে যাওয়ার পর আমাদের আড্ডা কমে গেল। আমরাও নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সে কল দিত ফ্রি সময়ে যেন শহরে চলে আসি। যেতাম সময় পেলে ঘুরতাম অনেক। মাস্টার পরীক্ষা দেওয়ার আগেও অনার্স বন্ধুদের নিয়ে একটা মিলনমেলার আয়োজন করার চেষ্টা করেছিলো সে, আমরা যথেষ্ট সাড়া না দেওয়াতে সে আর এগুতে পারেনি। মৃত্যুর আগে সবাই আর এক হতে পারেনি। সে চলে যাবে জানলে হয়তো আমরা প্রতিদিনই মিলনমেলার আয়োজন করতাম। শেষ দেখা আর হলোনা সবার সাথে, তার স্মৃতি পোড়াচ্ছে আমাদের সব বন্ধুদের।

স্বপ্নঃ আমরা একক ভাবে স্বপ্ন লালন করতাম না। সবসময় ছিল তিন কেন্দ্রিক সবকিছু। যাই করিনা কেনো যেনো তিনজন একসাথে থাকতে পারি। সবে মাত্র ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে ছেলেটা। ১বছর পর গাড়ি কিনবে, ২বছর পর ঘর করবে, ভাইকে বিদেশে পাঠাবে, এরপর বিয়ে করবে। কোন একদিন আমরা ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে বের হবো। একসাথে শহরে একটা ঘর করব, কত কি। না জানি এমন কত স্মৃতি তার পরিবার, আত্মীয় ও আরো বন্ধুদের সাথে সে করেছে।

সহনশীল রিফাতঃ সে এত বেশি সহনশীল ছিল। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। আমি কাছ থেকে দেখেছি সবসময় নিজের ইচ্ছেকে সে সেক্রিফাইস করতো। কতট্যুর কতকিছু মিস করেছে কিন্তু কখনো দেখিনাই তাকে হাই হুতাশ করতে। কেউ কিছু বললেও চুপ করে চলে আসত। আবার দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলতো। আসলে আমার বন্ধু জীবনে হাস্যকরভাবে সুখী ছিল।

ঘুরাঘুরিঃ আমাদের ঘুরাঘুরির কোন লিমিট ছিল না। কলেজে থাকাকালীন তিন পার্বত্য জেলা তিনদিন ভ্রমণের রেকর্ড আছে আমােদর। সর্বশেষ আমি যখন বাইক নিয়ে ট্যুর শুরু করি। সে থেকে এখন পর্যন্ত আমি সব ট্যুরে দুইজন মানুষকে নিতাম। রিফাত আর আজিম। রিফাতই মূলত বেশিভাগ সময় থাকত। হুট করে সে রাতে নক দিত বা আমি দিতাম বন্ধু বের হ ঘুরে আসি। কত জায়গায় গেলাম তার কোন হিসাব নেই। মুক্ত বিহঙ্গের মত যা আকাশে বিচরণ করার আনন্দ দিয়েছে আমাদের। মৃত্যুর কদিন আগেও কাপ্তাই ঘুরে এলাম। দুইটা রিসোর্ট দেখে এলাম সেখানে ক্যাম্পেইন করার কথাও বলে এলাম। চাকরী হওয়ার পর বলছে সামনের বছর দুজন মিলে ইন্ডিয়া বা নেপাল একটা ট্যুর দিব টাকা জমাতে। পূর্ণতা পায়নি আমাদের সেই ক্যাম্পেইন আর ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর।

আলমশাহপাড়া মানে রিফাতঃ আমার কাছে আলমশাহপাড়া মানে ছিল রিফাত। তার মাধ্যমে মূলত আলমশাহপাড়ার যারা আছে তাদের সাথে পরিচয় পরবর্তী সম্পর্ক। প্রতিদিন কাজ শেষে রাত ৯-১১ টা পর্যন্ত আড্ডা চলতো আমাদের। মৃত্যুর আগে কনকনে শীতে কেঁপে কেঁপে আলমশাহপাড়া পুরো রাউন্ড দিতাম আর দুই তিনটে চা খেতাম। এখন আর আমার আলমশাহপাড়া যাওয়া হয়না। বন্ধুদের

মধ্যমনি রিফাতঃ বন্ধুদের মাঝে মেলবন্ধন সৃস্টির মধ্যমনি ছিল রিফাত। আমরা অতটা ইজি ভাবে সবাইকে নিতাম না। তার কাছ থেকে শেখা অনেককিছু ছিল আমাদের। হয়তো আর নতুন বন্ধু আমাদের হবেনা। রহিমের বিয়েঃ রহিমকে বিয়ে করার জন্য সবচে বেশি পোশ করতো সম্ভবত রিফাতই। এই মৃত্যুর কদিন আগেও সব ঠিকঠাক করে এলাম সন্ধ্যা টু মধ্যরাত পর্যন্ত। এটা তিনজনের দীর্ঘ দিন পর আড্ডা ছিল। সেদিন মধ্যরাতেও সে বিরানি রান্নার কথা বলেছিল। রহিমের বিয়েতে একটা ব্যানার উঠাবে সে। আর সে ব্যানার থাকবে রহিমের সব খারাপ ছবিগুলে দিয়ে সমৃদ্ধ। রিফাতের মৃত্যুর তিনদিন পর রহিমের বিয়ে হলো। রহিম এক মিনিটও স্টেজে স্বাভাবিক ছিল না। পুরোটা রাত সে কান্না করেছে। সেদিন রাতে আমরা তিনজনের কত প্লান। চোখ ভিজে যাচ্ছিলো, আমি মুহুর্তের জন্য এসব মনে করতে পারছিলাম না। এমন মুহুর্তে আমাদের বন্ধু নক্ষত্র হয়ে গেল।

বাইকে স্বপ্নঃ সবসময় তার একটা বাইকের স্বপ্ন ছিল। গ্রুপ রুলস এর বাইরে গিয়ে বাইক না থাকা সত্বেও তাকে বাইক গ্রুপের সদস্য করি। আমি কোনদিনই তাকে যে তার বাইক নেই এটা বুঝতে দিইনাই। তবে আমার জানা মতে কারো কাছ থেকে কোনদিন সে বাইক নেই নি। তাকে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তুই বাইক চালাইতে পারিস কিন্তু কারো কাছ থেকে নিস না কেন। সে বলতো যেদিন নিজের টাকায় বাইক কিনতে পারবো সেদিন চালাবো। সব ট্যুরে সে পিলিয়ন থাকতো আমার। কোন ট্যুরের কথা আসলে আগে তাকে জিজ্ঞেস করতাম সে যাবে কিনা। এরপর বাকী সিদ্ধান্ত আসতো। এখন থেকে পিলিয়ন সিট আমার খালিই থাকবে।

মৃত্যুর তিনদিন আগে কেমন কাটালামঃ সে মারা যাওয়ার তিনদিন আগের রাতেও আলমশাহপাড়া আমাদের আড্ডা হয়েছিল। সম্ভবত দুই ঘন্টা একসাথে ছিলাম। পরদিন আমাদের জার্সি উন্মোচন ছিল। সে হুট করে কোন কারণ ছাড়া ধামাইরহাট ইদ্রিস ভাইয়ের দোকানে আসে। আমরা তখন লুডু খেলছিলাম। সে পাশে বসে ছিল চুপচাপ। পরে সে আমাদের জার্সিসহ বেশ কিছু ছবি তুলে দেয়। এরপর না বলেই চলে আসে। সেদিন একদম চুপচাপ ছিল। মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন আগের রাতে আমার পারিবারিক এক অনুষ্ঠান ছিল সেখানে এটেন্ড করেছিলাম। সেদিন আমাদের দেখা হয়নি আড্ডাও হয়নি। মৃত্যুর আগেরদিন রাতে জিজ্ঞেস করেছিলাম বন্ধু রহিমের বিয়ের জন্য ক্রেস্ট বানাইতে হবে। সে বলছে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি যেতে পারবো না। এটাই ছিল রিফাতের সাথে আমার ১৯বছবের শেষ মুহুর্তের কথা। এদিকে ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রিফাতের মা এখনো ছেলেকে খুঁজে বেডাচ্ছেন। আয়রন করা কাপড় নিয়ে ছেলের কবরে ছুটে গেছেন। আর কোনদিন ছেলের পছন্দের বিরানি খাবেন না বলে বারবার আর্তনাদ করছেন। ছেলে হারানোর পর থেকে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছেন না। বারবার ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন। ছেলের জন্য নির্ঘুম রাত আর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। ওনার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, ওনার সামনেও যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা। রিফাত কে হারানোর পর থেকে আমিও রাতে এখনো ঘুমুতে পারিনা। সে আমার সামনে চলে আসে। হয়তো আর কদিন থাকবে। এরপর আমাদের এই শোক কাটিয়ে ওঠবে। নতুুন করে আমরা আবার কাউকে বন্ধু বানিয়ে নিব। তাদের সাথে আমাদের অবসর, আনন্দ কাটবে। হয়তো রিফাতের মতো হবে না, তবুও কেটে যাবে। কিন্তু তার পরিবারের কথা ভাবলেই মনটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। অনন্তকাল শান্তিতে থাকুক রিফাত, ভালো থাকুক তার পরিবার, বেঁচে থাকুক আমাদের বন্ধুত্ব।

ব্যল্যবন্ধু, ইসমাঈল হোসেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

কাপ্তাই সেনা জোনের উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান

রিফাতের সাথে ৬৯৩৫ দিন

Update Time : 01:25:19 am, Sunday, 26 February 2023

এখন থেকে ঠিক ১৯বছর আগে রিফাতের সাথে আমার পরিচয় হয়। তখন পরনে ছিল একটা স্কুল ড্রস, একজোড়া দুই ফিতা ওয়ালা সেন্ডেল আর কাঁদে একটি ব্যাগ। তখন জীবনের মানে ছিল আমাদের কাছে নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল ড্রেস পড়ে স্কুলে আসা, টিফিনে হা-ডু-ডু কিংবা লুকোচুরি খেলা, কলম খেলা, সকালে জামাল স্যারের প্রাইভেট আর যতটা পারা যায় ফাঁকি দেওয়া। ধীরে ধীরে প্রাইমারি- হাই স্কুল-কলেজ- ভার্সিটি শেষে কর্মজীবনে সবে পা দিলাম দুজনে। ফসলের মত সময়ের সাথে পরিপক্ক হয়ে ওঠা বন্ধুত্ব হঠাৎ আসা কোনো ঝড়ের মতো গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় সে সম্পর্ক ৬৯৩৫ দিন একসাথে চলার পর ইতি টানলো। জীবন কখনো কখনো অনেক বড়ো পরীক্ষার অন্য এক নাম। তার এমন মৃত্যু আমাকে কাঁদায়, অনুভূতি শূন্য করে দেয়। রোগে ভুগে মৃত্যু হলেও মানসিকভাবে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু জীবনের সমস্ত বিপদ আপদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকা জ্বলজ্যান্ত মানুষটা হঠাৎ নাই হয়ে যাওয়া কিভাবে মানা যায়? অনন্তকাল ধরে কাঁদলে আমার ক্ষতির অনুভূতির গভীরতা বোঝা যাবে না। প্রচণ্ড শূন্যতা, প্রচণ্ড হাহাকার তার জন্য। এমন অনুভূতি আমি চাই না কখনোই। জীবনের সমস্ত বিপদ আপদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকা সবাইকে হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখা, বন্ধুদের সাথে সেলফি তোলা, আড্ডা দেওয়া ছিলেন এক জীবন্ত প্রাণ রিফাত তার সাথে স্কুল

জীবনের স্মৃতিঃ আমাদের শিক্ষা জীবনঃ স্কুল প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিলাম আকবর শিকদার পাড়া। প্রথমদিন ক্লাস ওয়ানে তার সাথে আমার পরিচয় হয় খেলাধুলার মাধ্যমে। ছোট বেলা থেকে সে ক্রীড়ামুখী ছিল। কখনও হা-ডু-ডু কখনো লুকোচুরি কিংবা দৌড়াদৌড়ি। প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে সেখান থেকে শুধু দুইজন ও আর আমি বৃহত্তর পরিবেশ উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথম তিনদিন ভয়ে স্কুলে যায়নি। পরেরদিন যাওয়ার পর সে আমাকে রিসিভ করে। একএক করে সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান দিল। সকালে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে স্কুলে যাওয়া, টিফিন টাইমে স্কুল পলায়ন করে ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা, কখনো লেট হলে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা, সমাবেশ ফাঁকা দিয়ে ঘুরতে যাওয়া দিনগুলো অস্থির ছিল। স্কুলে আমি, রিফাত, ইমরান আর জিশু ছিলাম এক ও অভিন্ন। কত দুষ্টামি কত কিছু সবকিছুর সাক্ষী স্কুলের দেয়াল আর বেঞ্চ গুলো। কলেজ জীবন ইন্টারে আমরা দুইজন আলাদা কলেজে ভর্তি হলেও প্রাইভেট ছিল একসাথে। তখন আমাদের সাথে এড হলো রহিম। দুইবছর পর আবারে অনার্সে ভর্তি হলাম একসাথে। তখন হয়ে গেলাম রহিমসহ আমরা তিনজন। শুরু হলো সব। এক এক করে চার বছর শেষ করলাম। শিক্ষা জীবনের সব চেয়ে মধুর স্মৃতি এখানে জড়িত। রিফাতের আদলে কত জনের সাথে বন্ধুত্ব হিসাব নাই। সে কলেজ শেষে নতুম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত। তাকে পেলে যে কতবার চলে আসছি হিসাব নাই। কলেজে প্যারা খাইলে একমাত্র তার জন্য খেতাম। সে আমার দূর্বলতাগুলো বলে দিত সবার সামনে। খুবই মজা হতো মুহুর্তগুলো। একসাথে কক্সবাজার সেন্টমার্টিন সমাপনী দিন পরীক্ষা কত জোস ছিল বলার মতো না। কলেজের বিভিন্ন টপিক সে আগেই শুরু করতো। এরপর আমরা সাড়া দিতাম। কলেজ নিয়ে সে সর্বশেষ স্টাটাস দিয়েছিল, “প্রিয়মুখ গুলোকে চাইলেও ভূলে থাকা সম্ভব না”। কিন্তু কদিন পর হয়তো তাকে সবাই ভূলে যাবে। এবস ভাবলে মনটা মুচড় দিয়ে ওঠে। টিউশন জীবন অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর আমরা তিনজনই টিউশন করাতাম। আমি পড়াতাম রহিমের কাজিনকে, রিফাত পড়াতো রহিমের ভাইপোকে আর রহিম পড়াতো তার এলাকার অন্য একজনকে। তিনটে টিউশন ছিল রহিমের বাড়ির পাশাপাশি। সপ্তাহের শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন আমরা পড়াতে যেতাম। এরপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রহিমের রুমে চলতো আমাদের আড্ডা। সে রহিমের ঘরে ডুকার আগে চিল্লাই বলতো আন্টি আমরা এসেছি কিছু খাব না, কিছু দিলে কিন্তু আমরা রাগ করবো। এটা বলা মানে আমাদের জন্য নাস্তা রেডি করা। রহিমকে সবসময় পাম্পিং করতো বিরানি রান্না করার জন্য। কারণ বিরানি ছিল আমাদের দুজনেরই প্রিয় খাবার। আমি জানি রহিমের আম্মুকে ভীষণভাবে ভুগাবে এই জিনিসটা। ভার্সিটি অনার্স শেষে আবার ভর্তি হলাম মহসিন কলেজে। জীবনে পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে রিফাত চলে যায় শহরে আমরা রয়ে গেলাম গ্রামে। সে চলে যাওয়ার পর আমাদের আড্ডা কমে গেল। আমরাও নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সে কল দিত ফ্রি সময়ে যেন শহরে চলে আসি। যেতাম সময় পেলে ঘুরতাম অনেক। মাস্টার পরীক্ষা দেওয়ার আগেও অনার্স বন্ধুদের নিয়ে একটা মিলনমেলার আয়োজন করার চেষ্টা করেছিলো সে, আমরা যথেষ্ট সাড়া না দেওয়াতে সে আর এগুতে পারেনি। মৃত্যুর আগে সবাই আর এক হতে পারেনি। সে চলে যাবে জানলে হয়তো আমরা প্রতিদিনই মিলনমেলার আয়োজন করতাম। শেষ দেখা আর হলোনা সবার সাথে, তার স্মৃতি পোড়াচ্ছে আমাদের সব বন্ধুদের।

স্বপ্নঃ আমরা একক ভাবে স্বপ্ন লালন করতাম না। সবসময় ছিল তিন কেন্দ্রিক সবকিছু। যাই করিনা কেনো যেনো তিনজন একসাথে থাকতে পারি। সবে মাত্র ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে ছেলেটা। ১বছর পর গাড়ি কিনবে, ২বছর পর ঘর করবে, ভাইকে বিদেশে পাঠাবে, এরপর বিয়ে করবে। কোন একদিন আমরা ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে বের হবো। একসাথে শহরে একটা ঘর করব, কত কি। না জানি এমন কত স্মৃতি তার পরিবার, আত্মীয় ও আরো বন্ধুদের সাথে সে করেছে।

সহনশীল রিফাতঃ সে এত বেশি সহনশীল ছিল। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। আমি কাছ থেকে দেখেছি সবসময় নিজের ইচ্ছেকে সে সেক্রিফাইস করতো। কতট্যুর কতকিছু মিস করেছে কিন্তু কখনো দেখিনাই তাকে হাই হুতাশ করতে। কেউ কিছু বললেও চুপ করে চলে আসত। আবার দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলতো। আসলে আমার বন্ধু জীবনে হাস্যকরভাবে সুখী ছিল।

ঘুরাঘুরিঃ আমাদের ঘুরাঘুরির কোন লিমিট ছিল না। কলেজে থাকাকালীন তিন পার্বত্য জেলা তিনদিন ভ্রমণের রেকর্ড আছে আমােদর। সর্বশেষ আমি যখন বাইক নিয়ে ট্যুর শুরু করি। সে থেকে এখন পর্যন্ত আমি সব ট্যুরে দুইজন মানুষকে নিতাম। রিফাত আর আজিম। রিফাতই মূলত বেশিভাগ সময় থাকত। হুট করে সে রাতে নক দিত বা আমি দিতাম বন্ধু বের হ ঘুরে আসি। কত জায়গায় গেলাম তার কোন হিসাব নেই। মুক্ত বিহঙ্গের মত যা আকাশে বিচরণ করার আনন্দ দিয়েছে আমাদের। মৃত্যুর কদিন আগেও কাপ্তাই ঘুরে এলাম। দুইটা রিসোর্ট দেখে এলাম সেখানে ক্যাম্পেইন করার কথাও বলে এলাম। চাকরী হওয়ার পর বলছে সামনের বছর দুজন মিলে ইন্ডিয়া বা নেপাল একটা ট্যুর দিব টাকা জমাতে। পূর্ণতা পায়নি আমাদের সেই ক্যাম্পেইন আর ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর।

আলমশাহপাড়া মানে রিফাতঃ আমার কাছে আলমশাহপাড়া মানে ছিল রিফাত। তার মাধ্যমে মূলত আলমশাহপাড়ার যারা আছে তাদের সাথে পরিচয় পরবর্তী সম্পর্ক। প্রতিদিন কাজ শেষে রাত ৯-১১ টা পর্যন্ত আড্ডা চলতো আমাদের। মৃত্যুর আগে কনকনে শীতে কেঁপে কেঁপে আলমশাহপাড়া পুরো রাউন্ড দিতাম আর দুই তিনটে চা খেতাম। এখন আর আমার আলমশাহপাড়া যাওয়া হয়না। বন্ধুদের

মধ্যমনি রিফাতঃ বন্ধুদের মাঝে মেলবন্ধন সৃস্টির মধ্যমনি ছিল রিফাত। আমরা অতটা ইজি ভাবে সবাইকে নিতাম না। তার কাছ থেকে শেখা অনেককিছু ছিল আমাদের। হয়তো আর নতুন বন্ধু আমাদের হবেনা। রহিমের বিয়েঃ রহিমকে বিয়ে করার জন্য সবচে বেশি পোশ করতো সম্ভবত রিফাতই। এই মৃত্যুর কদিন আগেও সব ঠিকঠাক করে এলাম সন্ধ্যা টু মধ্যরাত পর্যন্ত। এটা তিনজনের দীর্ঘ দিন পর আড্ডা ছিল। সেদিন মধ্যরাতেও সে বিরানি রান্নার কথা বলেছিল। রহিমের বিয়েতে একটা ব্যানার উঠাবে সে। আর সে ব্যানার থাকবে রহিমের সব খারাপ ছবিগুলে দিয়ে সমৃদ্ধ। রিফাতের মৃত্যুর তিনদিন পর রহিমের বিয়ে হলো। রহিম এক মিনিটও স্টেজে স্বাভাবিক ছিল না। পুরোটা রাত সে কান্না করেছে। সেদিন রাতে আমরা তিনজনের কত প্লান। চোখ ভিজে যাচ্ছিলো, আমি মুহুর্তের জন্য এসব মনে করতে পারছিলাম না। এমন মুহুর্তে আমাদের বন্ধু নক্ষত্র হয়ে গেল।

বাইকে স্বপ্নঃ সবসময় তার একটা বাইকের স্বপ্ন ছিল। গ্রুপ রুলস এর বাইরে গিয়ে বাইক না থাকা সত্বেও তাকে বাইক গ্রুপের সদস্য করি। আমি কোনদিনই তাকে যে তার বাইক নেই এটা বুঝতে দিইনাই। তবে আমার জানা মতে কারো কাছ থেকে কোনদিন সে বাইক নেই নি। তাকে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তুই বাইক চালাইতে পারিস কিন্তু কারো কাছ থেকে নিস না কেন। সে বলতো যেদিন নিজের টাকায় বাইক কিনতে পারবো সেদিন চালাবো। সব ট্যুরে সে পিলিয়ন থাকতো আমার। কোন ট্যুরের কথা আসলে আগে তাকে জিজ্ঞেস করতাম সে যাবে কিনা। এরপর বাকী সিদ্ধান্ত আসতো। এখন থেকে পিলিয়ন সিট আমার খালিই থাকবে।

মৃত্যুর তিনদিন আগে কেমন কাটালামঃ সে মারা যাওয়ার তিনদিন আগের রাতেও আলমশাহপাড়া আমাদের আড্ডা হয়েছিল। সম্ভবত দুই ঘন্টা একসাথে ছিলাম। পরদিন আমাদের জার্সি উন্মোচন ছিল। সে হুট করে কোন কারণ ছাড়া ধামাইরহাট ইদ্রিস ভাইয়ের দোকানে আসে। আমরা তখন লুডু খেলছিলাম। সে পাশে বসে ছিল চুপচাপ। পরে সে আমাদের জার্সিসহ বেশ কিছু ছবি তুলে দেয়। এরপর না বলেই চলে আসে। সেদিন একদম চুপচাপ ছিল। মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন আগের রাতে আমার পারিবারিক এক অনুষ্ঠান ছিল সেখানে এটেন্ড করেছিলাম। সেদিন আমাদের দেখা হয়নি আড্ডাও হয়নি। মৃত্যুর আগেরদিন রাতে জিজ্ঞেস করেছিলাম বন্ধু রহিমের বিয়ের জন্য ক্রেস্ট বানাইতে হবে। সে বলছে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি যেতে পারবো না। এটাই ছিল রিফাতের সাথে আমার ১৯বছবের শেষ মুহুর্তের কথা। এদিকে ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রিফাতের মা এখনো ছেলেকে খুঁজে বেডাচ্ছেন। আয়রন করা কাপড় নিয়ে ছেলের কবরে ছুটে গেছেন। আর কোনদিন ছেলের পছন্দের বিরানি খাবেন না বলে বারবার আর্তনাদ করছেন। ছেলে হারানোর পর থেকে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছেন না। বারবার ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন। ছেলের জন্য নির্ঘুম রাত আর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। ওনার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, ওনার সামনেও যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা। রিফাত কে হারানোর পর থেকে আমিও রাতে এখনো ঘুমুতে পারিনা। সে আমার সামনে চলে আসে। হয়তো আর কদিন থাকবে। এরপর আমাদের এই শোক কাটিয়ে ওঠবে। নতুুন করে আমরা আবার কাউকে বন্ধু বানিয়ে নিব। তাদের সাথে আমাদের অবসর, আনন্দ কাটবে। হয়তো রিফাতের মতো হবে না, তবুও কেটে যাবে। কিন্তু তার পরিবারের কথা ভাবলেই মনটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। অনন্তকাল শান্তিতে থাকুক রিফাত, ভালো থাকুক তার পরিবার, বেঁচে থাকুক আমাদের বন্ধুত্ব।

ব্যল্যবন্ধু, ইসমাঈল হোসেন।